Daily Prothom Barta - Menu
১৩৯ জন মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা বিনিময়ে বক্তাবলী গণহত্যা দিবস আজ
নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বক্তাবলী এলাকায় একাত্তরের এই দিনে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী হামলা চালিয়ে ১৩৯ জন মুক্তিযোদ্ধা ও নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। জ্বালিয়ে দেয় ২২ টি গ্রাম। সে থেকে ২৯ নভেম্বর বক্তাবলী গণহত্যা দিবস পালন করা হয় ।
তবে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নিহতের পরিবারের সদস্যরা ৪৬ বছরেও সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এখনো পায়নি তারা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।
২৯ নভেম্বর আসলেই শান্তনা স্বরূপ অনেকে আসেন বক্তাবলীতে।আসেন জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারসহ অনেকে। জনপ্রতিনিধি আর প্রশাসনের কর্মকর্তারা এসে দিয়ে যান নানা প্রতিশ্রুতি।
সারাবছর আর কেউ খবর নেয় না। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল হলেও তারা ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত ১৩৯ জনের পরিবারের কারও খোঁজ-খবর নেয় না।
২৯ নভেম্বর আসলে সাংবাদিকরা পত্রিকায় লেখার জন্য এসে একটু খবর নিয়ে আলোচনা করেন। পরে আর কেউ খবর নেন না। বেশির ভাগ শহীদ পরিবার অস্বচ্ছল। তারা সরকারি ভাবে সাহায্য পাচ্ছে না। তবে গত বছর নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ১৯৭১ সালে বক্তাবলীতে পাক হানাদার বাহিনী নির্মতার শিকার ১৩৯ পরিবারকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ব্যবস্থা করে দেয়ার আশ্বাস দিলেও আজও বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
তিনি পরিবারগুলোর সদস্যদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেছেন, স্বাধীনতার ৪৬ বছরে পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয়নি এটা পরিতাপের বিষয়। তাই পরিবারগুলোর তালিকা করে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. আলীর কাছে জমা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
পরে সেই তালিকা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শহীদের পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু মুখে বলা পর্যন্ত শেষ। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কেউ তাদের খবর রাখে না।
জানা গেছে, ২৯ নভেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধাদের উপুর্যপরি আক্রমণের মুখে পাক হানাদাররা পিছু হঠতে শুরু করে। এসময় রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর পরামর্শে তারা ১৩৯ জন নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে ধরে এনে লাইন ধরিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। এতে নিহত হয় শাহিদ, ফারুক, অহিদ, মনির, শাহ আলম, রহমতউলাহ, শামসুল, আলম, সালামত, খন্দকার, সুফিয়া, আম্বিয়া, খোদেজাসহ ১৩৯ জন। পিছু হটার সময় হানাদার বাহিনী পেট্রোল ও গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয় বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী পার সংলগ্ন বক্তাবলী পরগনার, লক্ষীনগর, রাজাপুর ডিগ্রীর চর, মুক্তাকান্দি, গঙ্গানগর, রাম নগর, কানাইনগর, গোপাল নগর, রাধানগরসহ ২২ টি গ্রাম। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতি বছর নারায়ণগঞ্জবাসী বক্তাবলী দিবস পালন করে আসছে। তখন থেকেই ১৩৯ জন নিহত হওয়া ও ওইদিন পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধের খবর জেনে আসছিল নারায়ণগঞ্জবাসী। জেলার সকল স্তরের মুক্তিযোদ্ধারাও বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য আর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বর্ণনা করেছেন সেই নির্মম ঘটনা।
নদীবেষ্টিত দুর্গম চরাঞ্চল হওয়ায় এলাকাটিকে নিরাপদ মনে করতো মুক্তিযোদ্ধারা। বক্তাবলীতে অবস্থান করেই মূলত মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন করার পরিকল্পনা করতো। ওই এলাকাতে তখন কমান্ডার ছিলেন প্রয়াত সিরাজুল ইসলাম।
এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত যুগ্ম আহ্বায়ক মফিজুল ইসলাম, বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার কাউন্সিলার আজহার হোসেন, আবদুর রব, মাহফুজুর রহমান, স ম নুরুল ইসলামসহ আরো অনেকে তখন বক্তাবলীতে অবস্থান করতো। ঘটনার দিন তথা ২৯ নভেম্বর ছিল প্রচণ্ড শীত। সকাল থেকেই ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন ছিল পুরো এলাকা। নদীবেষ্টিত হওয়ায় কুয়াশা ছিল অনেক বেশি।
ভোরের দিকে হঠাৎ করেই পাক বাহিনী গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দেয়। উভয় পক্ষের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুন্সিগঞ্জ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ব্যাটালিয়ন বক্তাবলীতে এসে এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিলে তাদের শক্তি বৃদ্ধি পায়। পরে তারা একত্রে পাক বাহিনীর সঙ্গে প্রায় চার ঘণ্টা একটানা যুদ্ধ চালায়।
এসময় মুক্তিযোদ্ধারা মোক্তারকান্দি কবরস্থানের সামনে কয়েকজন রাজাকারকে ধরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের উপুর্যপরি আক্রমণের মুখে পাক হানাদাররা পিছু হঠতে শুরু করে। এ সময় তারা রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর পরামর্শে ১৩৯ জন নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে ধরে এনে লাইন ধরিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী জানান, ২৯ নভেম্বর বক্তাবলীতে তিন থেকে চার ঘণ্টা একটানা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাক বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। পরে পাক বাহিনী পালিয়ে যাওয়ার সময়ে ১৩৯ জনকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে।
ফতুল্লা থানা সংলগ্ন যমুনা তেল ডিপোর আশপাশের জেটিতেও অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছিল।